ছন্দছাড়া কথা অকথার গদ্য

ছন্দছাড়া কথা অকথার গদ্য
_____________________________________________________________________________________________________________________
এই ব্লগে আমার যে কোন পোষ্টে সকল পাঠকের সুচিন্তিত মন্তব্য আশা করি।

বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৩

|| ভূতের মন, ঘর, সংসার || [২]

||........[২]

মান্না ডান হাতের তর্জনী কপালের ওপর দুতিনবার নাচায়, বিড় বিড় করে কী যেন বলে, তারপর কৌটোয় কাপড় বাঁধা চা-ছাকনিটা তুলে চা ছাঁকবার আগে বুড়ো আঙুলের গোড়া কপালের ওপর তিনবার ছুঁইয়ে নেয়। চা ছাঁকতে ছাঁকতে মনে মনে বলে, ----শালা, আমরা নিজেদের মন খারাপ করার সময় পাইনা তার আবার ভূতের মন খারাপ। ভূতের আবার মন খারাপ কি? যারা ভূত হয়ে পৃথিবীতে নামে, মানুষকে জ্বালায়, ভয় দেখায় তাদের মন খারাপের কারন কী ? তারা তো দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, এখানে তাদের বিষয় সম্পত্তি ঠিক আছে কি না দেখতে পাচ্ছে, লোকের সঙ্গে রাত দুপুরে নির্জনে মস্করা করছে, মন খারাপের তো কোন চিহ্ণ দেখিনা। সামন্তদাদের অঢেল সময় এসব নিয়ে ভাবে। ভেবে রাতের ঘুম হয় না, তবু ভাবে। আরে বাবা, নিজের ভাবনা ভাব, তা নয় ভূতের মন নিয়ে ভাবতে বসল। আদিখ্যেতার একটা শেষ থাকা উচিত।

***********     ************

সামন্ত হাসি মুখে ফিরে এসে বলে, “বুঝলি রবিন, আজ দুপুরে তুই আমাদের বাড়িতে খাবি। আমি বাড়িতে সে কথা বলতেই গেছিলাম। বৌও খুব খুশি, বলল ‘রবিনদা তো সেই কবে এসেছিলেন, মা বেঁচে ছিলেন তখন। ভালই হবে আজ এলে একচোট ঝগড়া করা যাবে, জংলী ভূত একটা’”।
--- কি ? আমাকে জংলী ভূত বলল? কেন?
সামন্ত হা হা করে হাসে, বলে, “ওরে, সেতো আমাকেও বলে। আসলে আমার মা’ই তো শিখিয়েছে। বিয়ের পরদিন বাড়ি এসেছি বৌ নিয়ে। বরণ করার পরে মা বৌকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলল, মা’ আমিতো চিরকাল থাকব না। আমার ছেলেটা একটা জংলী ভূত, ওকে দেখে শুনে রাখার দায়িত্ব তো তোমাকেই নিতে হবে। তাই বলে গেলাম, একটু বকা ঝকা করে সামলে নিও”। মা যদ্দিন বেঁচে ছিল তদ্দিন বৌ কিছু বলেনি। মা স্বগ্গে চলে গেল, মেয়েদের তিন দিন কজের শেষে বৌ বলল, “উনি তো চলে গিয়ে বাঁচলেন, জংলী ভূতটাকে আমার ঘাড়ে রেখে গেলেন। আমার যে কবে যাওয়া কে জানে !” সেই থেকে আজ দু’বছর প্রত্যেক দিন পাঁচ বার করে এই নাম শুনে শুনে আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম সত্যি আমি বুঝি ‘জংলী ভূত’। ক্রমশ মন খারাপ হতে থাকল, ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সকালে তুই ওই কথাটা না বললে আমার মাথায় ঢুকত না যে, মন খারাপ করা মানেই হচ্ছে আমি ভূত না, আর ভূতই যদি না হব তবে সে কথা ভেবে মন খারাপ করব কেন। বৌকেও সে কথা বললাম।
--- শুনে কী বলল ?
--- “জংলী ভূত একেকটা”। মানে তোকেও বলল। হা হা হা।

****************    ************
---সামন্ত, এবার ক্ষান্ত দে, আর খাস না শরীর খারাপ হবে।
---ঠিক বলেছিস, অনেকগুলো খেলাম। অনেক দিন পর তুই আর আমি একসাথে এই হরিরামের দোকানে কচুরি খাচ্ছি। আজকে মনটা আমার ভালও আছে রে রবিন। বৌ যেদিন প্রথম আমাকে বলল ‘জংলি ভূত’ সেদিন মজাই পেয়েছিলাম, খুব হেসেছিলাম। তারপর থেকে ওর যে কী হ’ল, যখন তখন যার তার সামনে বলতে শুরু করল। ক্রমশ বাড়তে বাড়তে প্রতিদিন, তারপর দিনের মধ্যে চার বার পাঁচ বার ঐ এক কথা। রাগলেও জংলি ভূত, হাসলেও জংলি ভূত। মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হ’তাম কিন্তু কিছু বলতাম না। ভাবতাম যাকগে, মন থেকে তো আর বলছে না, বলুক, কী আর করা যাবে। বুঝলি রবিন, পরের দিকে আর ভাল লাগতো না। ভাবতাম, আমি নিজেই কি ভূতের মত? আস্তে আস্তে আমার মনের মধ্যে একটা চাপ তৈরি হতে থাকল। মূষরে পড়লাম। বৌ জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে? আমি কোনো উত্তর দিই না। উত্তর দিয়ে কী হবে, ও তো বোঝেই না। উত্তর না পেয়ে আরও রেগে যায়, “আর কাউকে পেল না, কোথাকার এক জংলি ভূতের সঙ্গে বিয়ে দিল বাবা। পালাব যে তারও তো উপায় নেই”। শেষ কথাটা আমার মনে আরও চাপ বাড়িয়ে দিল। ভাবলাম, সত্যি আমি ভূত। আর ভূতেদের গতিবিধি তো সর্বত্র, শক্তিও অসীম। পালালে যদি ঘাড় মটকে দিই সেই ভয়েই ও পালানোর উপায় নেই বলছে। এভাবে চলতে পারে কখনো, রবিন? রাতের ঘুম চলে গেল, খুঁটি নাটি কাজে ভুল করতে থাকলাম। খাওয়া দাওয়া কমে গেল, মুখের স্বাদই চলে গেছিল। বৌ তো বোঝে না। একদিন দুপুরে দুজনে খেতে বসেছি, বৌ বলল, “জংলি ভূতের সাথে একসাথে বসে খাওয়া যায়? কী যে কপাল আমার”। আমি তখন কী একটা যেন মুখে পুরেছিলাম। গলায় আটকে গেল, বুকের ব্যাথাটা বেড়ে গেল, কথা বলতে পারছি না। এদিকে বৌয়ের তো সেসবে খেয়াল নেই। ও বুঝতেই পারছে না। কিছুক্ষন পরে আমি কোথায় আর ও কোথায় আমি আর কিছু বুঝতেই পারলাম না।
--- তারপর ?
--- তারপর আর কী ? এই তো, আমি ভূত ! সামন্ত ভূত, জংলি ভূত, জঙ্গলে থাকি। হাঃ হাঃ হাঃ ... ... না রে, সত্যিই বেশি কচুরি খাওয়া হয়ে গেল, উচিত হয় নি। দুপুরে আবার বাড়িতে খেতে হবে তো।
--- হ্যাঁ, তোর বৌ তো ভালই রান্না করে, চল ওঠ।
সামন্তর কথার রেশটা রবিন আর টানতে চায় না। সামন্তর মনের অবস্থা একটু ভাল হয়েছে, ওর ভুল ভেঙেছে। এটা দরকার। ভাল আছে, ভাল থাকলেই হ’ল। অত সব কথা জানতে চেয়ে রোগ বাড়িয়ে লাভ নেই।

এদিকে ওদের টেবিলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে দোকানী হরিরাম। মনে হচ্ছে বাপের জম্মে সামন্ত আর রবিনকে একসাথে দেখেনি। ওদের খাওয়া শেষ হওয়ারও কিছু পরে আস্তে করে হাঁ বন্ধ করে একটা ঢোঁক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নিয়ে হরিরাম মাথাটা ঘুরিয়ে নিল। এ নিয়ে কাউকে আর কিছু বলল না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন